Skip to main content

ইসলামী শাসনব্যবস্থার বিলুপ্তি ও মুসলিম দেশসমূহে পশ্চিমাদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর মুসলিম প্রজন্ম ক্রমান্বয়ে ইসলামের যেই মহামূল্যবান জিনিসটি হারিয়েছে সেটা হল গায়রাত, দ্বীনি আত্মমর্যাদা এবং ইসলামী শরীয়াহর প্রতি স্বভাবজাত সংবেদনশীলতা। গায়রাত এমন এক শক্তিশালী অনুভূতি যা বান্দাকে আল্লাহর দ্বীন পালন ও তার উপর অটল থাকতে সহায়তা করে। ইসলাম সামগ্রিকভাবে মুসলিমদেরকে প্রতিপালন করে এই গুণেরই উপর।
ইবনুল কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, দ্বীনের মূল ভিত্তি হল গায়রাত। যার গায়রাত নেই তার কোন দ্বীনই নেই। এজন্যই দাইয়্যুস আল্লাহর সৃষ্টিজীবের নিকৃষ্ট ব্যক্তি, যার উপর জান্নাত হারাম হয়ে যায়। (আল জাওয়াবুল কাফি, ৬৮)
গায়রাত এমনই একটি মহৎ গুণ যা মহান আল্লাহ তা’য়ালা থেকে শুরু করে নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম, সাহাবায়ে কেরাম, উলামায়ে আসলাফ সকলেই এই গুণে গুণান্বিত ছিলেন। হাদীস শরীফে এসেছে, আল্লাহর থেকে বেশি গায়রাতসম্পন্ন কোন সত্তা নেই। এজন্যই তিনি প্রকাশ্য- অপ্রকাশ্য সমস্ত অশ্লীলতাকে হারাম করে দিয়েছেন। ( সহীহুল বুখারী, ৫২২০)
নবী রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামের গায়রাত নিয়েও অসংখ্য বর্ণনা আছে। তার মধ্যে কেবল একটি হাদীস আমি এখানে উল্লেখ করছি। এই হাদীস থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবাদের গায়রাত সম্পর্কে আমরা জানতে পারব। একবার সা’দ বিন উবাদা রা. বললেন, যদি আমি আমার স্ত্রীর সাথে (গাইরে মাহরাম) কোন পুরুষকে দেখি তাহলে আমি তরবারি দিয়ে তার গর্দান ফেলে দিব। রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সা’দের এই বক্তব্য পৌঁছলে তিনি সাহাবাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, তোমরা কি সা’দের গায়রাত দেখে আশ্চর্য হচ্ছো? আল্লাহর শপথ! আমি সা’দের থেকেও বেশি গায়রাতসম্পন্ন এবং মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমার থেকেও বেশি গায়রাতসম্পন্ন। (সহীহুল মুসলিম, ১৩৯৮)
ইসলামের গায়রাতের ধারণাটা অনেক ব্যাপক। এটা কেবল স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সততা বজায়ের ভিতরই সীমাবদ্ধ নয়, বরং পুরো ইসলামী শরীয়াহর প্রতি গভীর সংবেদনশীলতা এবং দায়িত্ববোধের নাম হল গায়রাত। যে কোনো পাপাচারের প্রতি ঘৃণাবোধ এবং যে কোনো সৎকর্ম ও নিদর্শনের প্রতি ভালবাসা থাকার নাম গায়রাত। উলামায়ে কেরাম গায়রাতকে মৌলিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হল প্রশংসিত, আরেকটি হল নিন্দনীয়। প্রশংসনীয় গায়রাত হল, যেটা বান্দাকে আল্লাহর দেয়া শরীয়াহর প্রতি সিরিয়াস করে তোলে। আর নিন্দনীয় গায়রাত হল, যেটা বান্দাকে আল্লাহর দ্বীন পালনে লজ্জিত ও ইতস্তত করে তোলে।
বর্তমান সময়ে আমরা এই বিভাজনকে এভাবে ব্যক্ত করতে পারি যে, ইসলামী গায়রাত ও পশ্চিমা গায়রাত। আজকে ইসলামের প্রতি আমাদের গায়রাত নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি গায়রাত বেড়ে গেছে। দাড়ি রাখতে আমাদের লজ্জাবোধ হচ্ছে, কাটতে নয়। হিজাব পরতে ইতস্ততবোধ হচ্ছে, হিজাব খুলতে নয়। আমরা যতটা না ইসলামের প্রতি সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল, তার থেকেও বেশি পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি সংবেদনশীল এবং দায়িত্বশীল হয়ে উঠছি।
অভিভাবকরা সন্তানদেরকে ফ্রি মিক্সিংয়ের পরিবেশে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। মেয়েদেরকে কথিত বয়ফ্রেন্ড ও বন্ধুর সাথে যেথায় সেথায় ট্যুরে যাওয়ার জন্য স্বাধীন ছেড়ে দিচ্ছে। উম্মতের ছেলেরা অবাধে আজকে গানবাদ্য ও গাইরে মাহরাম নারীদের সাথে সময় কাটাচ্ছে। উম্মাহর মেয়েরা কোন প্রকার ইতস্ততবোধ ছাড়াই ফ্রি মিক্সিংয়ে লিপ্ত হচ্ছে ও পর্দাহীনতার কালচারে জড়িয়ে পড়ছে। স্বামী তার স্ত্রীকে পুরুষদের বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। অথচ গায়রাত সম্পন্ন কোন মুসলিম-মুসলিমাহ এই কাজগুলো করতে পারে না।
আজকে আমাদের ঈমানি গায়রাত এতোটাই হ্রাস পেয়েছে যে, অশ্লীলতা ও হারাম বিনোদনের তারকা-সেলিব্রেটিদের প্রতি নিজেদের সর্বোচ্চ ভালবাসা ও উন্মাদনা উজাড় করে দিচ্ছি। অথচ ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ নিয়ে আমাদের মাঝে তেমন ভালবাসা ও উন্মাদনা কাজ করে না। এসব জাহেল সেলিব্রেটি আক্রান্ত হলে আমরা যতটুকু ব্যথিত ও সরব হই, ইসলামের কোন বিধানের উপর আঘাত আসলে তার ছিটেভাগও সরব হই না।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলছেন, আল্লাহর বিধান কার্যকর করতে গিয়ে তোমাদের অন্তরে যেন দয়ার উদ্রেক না হয়। (সূরা নুর, আয়াত ২)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এই আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে পাপাচারীদের প্রতি ভালবাসা, টান ও আগ্রহ রাখতে নিষেধ করেছেন। কারণ কেবল এই টানের কারণেই অনেকে পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং গায়রাতহীন হয়ে যায়। কেউ কেউ মনে করে এদের প্রতি ভালবাসা ও টান থাকাটাই উত্তম চরিত্রের পরিচায়ক। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বরং এই টান থাকাটা পাপে সহায়তা, দ্বীনহীনতা ও অসৎ কাজে অন্যকে নিষেধ করার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার নামান্তর। ( মাজমুউল ফাতাওয়া- ১৫/ ২৮৭.২৮৮)
বর্তমান প্রজন্মের গায়রাত নষ্ট হওয়ার অন্যতম দুটি কারণ হল, অশ্লিলতা ও ফাসাদ বিস্তারকারী মিডিয়া জগত এবং ফ্রি মিক্সিংয়ের পরিবেশে বিচরণ করা। ফিল্ম, নাটক, আইটেম সং, হারাম রিলেশন ও নারীঘেঁষা বিভিন্ন প্রচারণার ফলে মুসলিমদের গায়রাত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাদের কাছে ইসলামের সুস্পষ্ট হারাম বিষয়গুলো স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। এবং এগুলোর প্রতি তাদের স্বভাবজাত যেই ঘৃণাবোধ থাকার কথা ছিল সেটা হারিয়ে যাচ্ছে।
শাইখ আব্দুল্লাহ আল ফাওজান বলেন, কোন মানুষ যদি এমন স্থানে অবস্থান করে যেখানে অধিকহারে পাপাচার হয়, তা হলে তার গায়রাত হয়ত দুর্বল হয়ে যাবে কিংবা একেবারেই মরে যাবে। (হুসুলুল মামুল বিশারহি সালাসাতিল উসূল, ১৭৬)
এজন্যই দেখা যায়, মুসলিমদের মধ্যে যারা কাফেরদের দেশে পড়াশোনা করতে যায়, তাদের দ্বীনি গায়রাত একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্তমান শিক্ষাঙ্গন, শপিং মল, বিনোদন স্পট এবং বড় বড় রেস্তোরাঁগুলোও ফ্রি মিক্সিং ও পাপাচারের পরিবেশে রূপ নিয়েছে। ফলে এইসব পরিবেশে যারা অধিক পরিমাণে বিচরণ করছে তাদের গায়রাতও হুমকির মুখে পড়ছে।
প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা! গায়রাত অনেক মহামূল্যবান জিনিস। এই গায়রাতকে সংরক্ষণ করা আমাদের পবিত্রতম দায়িত্ব। গায়রাত হারিয়ে ফেলার কারণে আজ অনেক মুসলিমই দ্বীনত্যাগ করে জাহান্নামের দিকে পা পাড়াচ্ছে, কিন্তু তারা নিজেরা বিষয়টা অনুভবও করতে পারছে না। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি তোমার লজ্জা (গায়রাত) না থাকে, তবে তুমি যা ইচ্ছা তাই করে ফেলতে পারো। ( সহীহুল বুখারী,৩৪৮৪)
বর্তমান সময়ে মহামূল্যবান এই গায়রাতকে হেফাজত করতে হলেঃ
এক. আমাদেরকে অশ্লীল মিডিয়া ও হারাম বিনোদন জগতকে পরিত্যাগ করতে হবে।
দুই. শিক্ষাঙ্গন, বিনোদন স্পট, শপিং মল, রেস্তোরাঁ সহ যেকোন পাপাচার ও ফ্রি মিক্সিংয়ের পরিবেশকে এড়িয়ে চলতে হবে। পাশাপাশি এই ধরণের পরিবেশ যেন তৈরি না হয়, তার জন্য মুসলিম তরুণ-তরুণীদেরকেও সতর্ক করতে হবে। বিশেষত অধীনস্থ নারীদের ভিতর নিজের গায়রাতের ব্যাপারে অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে হবে।
একবার আলী রা. কে এক শহরে পাঠানো হল সেখানকার অধিবাসীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেয়ার জন্য। তিনি সেখানে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি শুনেছি তোমাদের নারীরা বাজারে অনারব কাফেরদের সাথে ভিড় জমাচ্ছে।
তোমাদের কি গায়রাত নেই। যার গায়রাত নেই তার মাঝে কোন কল্যান নেই। (মুসনাদে আহমাদ, ১১১৮)
অন্য এক বর্ণনা মতে আলি রা. বলেছেন, তোমাদের কি লজ্জা নেই? গায়রাত নেই? তোমরা নারীদেরকে পুরুষদের মাঝে ছেড়ে দিয়েছো। তারা পুরুষদেরকে দেখছে, পুরুষরাও তাদেরকে দেখছে! ( কিতাবুল কাবাইর, ১৭১)
তিন. মসজিদ ও দ্বীনি সার্কেলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আজেবাজে জায়গা ও আড্ডায় সময় নষ্ট না করে পড়াশোনা কিংবা দ্বীনি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সময় দিতে হবে। অবসর না থেকে সর্বদাই নিজেকে কল্যানময় কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। এবং বৈধ বিনোদনের জন্যও দ্বীনি সার্কেলকেই বেছে নিতে হবে।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সকলের মাঝে দ্বীনের গায়রাতকে বৃদ্ধি করে দিন এবং তাকে সংরক্ষিত রেখে আমাদেরকে গায়রাত সম্পন্ন মুসলিম হিসেবে কবুল করে নিন। আমিন।

-লেখক Iftekhar Sifat ভাই

Share: